২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে ই-কমার্স প্লাটফর্ম ইভ্যালি। লোভনীয় ডিসকাউন্ট কিংবা ক্যাশ ব্যাকের অফার দিয়ে দ্রুতই গ্রাহকদের কাছে পরিচিতি পেয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সময়মত পণ্য না দেওয়াসহ নানা অভিযোগে বর্তমানে সমালোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে ইভ্যালি।
লোক ঠকানোর বহু অভিযোগের পর গ্রাহকের করা মামলায় ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে সম্প্রতি গ্রাহকের করা প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তারও করে র্যাব।
আর হাজার হাজার ক্রেতা-বিক্রেতার শত শত কোটি টাকার পাওনা বুঝিয়ে দিতে না পারা ইভ্যালিকে কোম্পানি আইন অনুযায়ী অবসায়নের মাধ্যমে দেনা পরিশোধের প্রস্তাব করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিডিনিউজ২৪।
শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি আয়োজিত ‘ই-কমার্স খাতের চ্যালেঞ্জ: সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট ও করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এই প্রস্তাব আসে।
বক্তারা বলেন, হাজারো অভিযোগের মুখে থাকা ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর অনিয়ম ঠেকাতে বিদ্যমান আইনই যথেষ্ঠ। প্রয়োজন শুধু সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সততা, সমন্বয় ও সক্ষমতা বাড়ানো।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম বলেন, আইনের অভাব নাই, নতুন আইনেরও দরকার নাই। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা যদি বাড়ানো যায় এবং সেই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সততার সাথে কাজ করে তাহলে এ ধরনের অনিয়ম ঠেকানো যাবে।
“বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) যেসব আইন আছে, তা দিয়ে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।”
বিভিন্ন আইনের বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলো ‘পদে পদে অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে’ মন্তব্য করে প্রতিযোগিতা কমিশন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উদাহরণ টানেন কর্পোরেট আইন বিশেষজ্ঞ তানজিব।
তিনি বলেন, কোন কোন অবস্থায় প্রতিযোগিতা কমিশন পদক্ষেপ নেবে সেগুলো প্রতিযোগিতা আইনে বলা আছে। কিন্তু আমরা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, প্রতিযোগিতা কমিশনের যখন যেখানে তৎপর হওয়ার দরকার ছিল, তখন ওনারা বসেছিলেন, পদক্ষেপ নেন নাই।”
ই-কমার্সের কয়েকটি কোম্পানির টাকা নিয়ে পণ্য না দেওয়ায় ভোক্তা অধিদপ্তরে প্রায় ১৭ হাজার অভিযোগ পড়ার তথ্য তুলে ধরে তানজিব বলেন, কিন্তু এতো বেশি অভিযোগ নিয়ে কাজ করার মতো জনবল ও দক্ষতা কোনটাই ওই প্রতিষ্ঠানের নেই। অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানও সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) নেতৃত্ব দিতে পারতো বলে মনে করেন আর্থিক খাতের শীর্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির এই আইনজীবী।তিনি বলেন, সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইভ্যালির লেনদেন একমাস বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু এরপর ওই নিষেধাজ্ঞা আর বাড়ানো হয়নি অথবা নিষেধাজ্ঞা বলবৎও রাখা হয়নি।
“তখন স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ মনে করল, যে বিএফআইইউ এ বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করেছে বা পরীক্ষা করে দেখেছে তাহলে সমস্যা নেই। তখন ইভ্যালি আরও শতগুণ মনোবল বাড়িয়ে আরও ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, গত আট মাসে ই-কমার্সে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। সুতরাং সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণেই জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তানজিব বলেন, বিএফআইইউর ঘটনার পর আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি সংস্থাকে ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু তারা দুই রকম প্রতিবেদন দিল। ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই ঘটনার বিস্তারিত তদন্তে যে রকম জ্ঞান ও দক্ষ লোকবল দরকার তা নেই। সুতরাং বিষয়টি এভাবেই ঘোলা হয়েছে। এখন জনগণের পাওনা টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন? অনেকে বলাবলি করছে, যে সরকারি অর্থায়ন থেকে জনগণের পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হোক।”
এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “জনগণের করের টাকা সরকারের কাছে আমানত। একজনের লুটপাটের টাকা পরিশোধে আমি ট্যাক্স দিইনি- এটা সংবিধানবিরোধী। তাই এখন কোম্পানি আইন অনুযায়ী ওই কোম্পানিকে অবসায়ন করে যে অর্থ পাওয়া যায় তা দিয়ে পাওনা পরিশোধ করা যেতে পারে।
“এক্ষেত্রে যে লোকের ২০ হাজার টাকা পাওনা আছে তাকে এক হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব হলে, তাকে ওইটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই করের টাকায় এই পাওনা পরিশোধ করা যাবে না।”
লোক ঠকানোর বহু অভিযোগের পর গ্রাহকের করা মামলায় ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে সম্প্রতি গ্রাহকের করা প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার করে র্যাব।
তারপর থেকে ইভ্যালির হাজার হাজার গ্রাহক উৎকণ্ঠায় রয়েছেন তাদের পণ্য পাওয়া নিয়ে, যার জন্য মূল্য পরিশোধ তারা আগেই করেছেন।মাত্র তিন বছর আগে গড়ে ওঠার পর লোভনীয় অফার ও চটকদার বিজ্ঞাপনে খুব দ্রুতই আলোচনায় আসে ইভ্যালি। কিন্তু গ্রাহকের অভিযোগের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপে বেরিয়ে আসে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দেনা ৪০৩ কোটি টাকা।
সর্বশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালির পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির মোট চলতি দায় ৫৪৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে মার্চেন্ট বা পণ্য সরবরাহকারীরা পাবেন ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আর গ্রাহকদের পাওনা ৩১১ কোটি টাকা।
ব্রাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আরএফ হোসাইন বলেন, ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ বেশ কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানি দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় বিপদ সংকেত দিয়েছে। ইভ্যালিসহ সম্প্রতি যা ঘটেছে তা সকল পক্ষের লোভের কারণেই হয়েছে।
“এখন জনগণের বিপুল পাওনা টাকা কোথায় আছে, তা খুঁজে বের করে যেটুকু পাওয়া যায়, তাই ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”
দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সবগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই ই-কমার্স খাত নিয়ন্ত্রণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তবে ই-কমার্সের জন্য নতুন করে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হলে বা এ খাতে নতুন নতুন নিয়মকানুন বেঁধে দেওয়া হলে এখাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর।
আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হাতে যেসব আইন আছে তা দিয়েই ই-কমার্স খাত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু তাদের লোকবল সেরকম লোকবল নেই।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর ‘ডিজিটাল মনিটরিং’ দরকার। কিন্তু তা করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও জনবল সরকারের নেই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতাও বড় সমস্যা।
অবসায়ন কোম্পানির আইনগত অস্তিত্বের সর্বশেষ পযার্য়। কোম্পানির কারবার গুটিয়ে ফেলার নামই হল কোম্পানির অবসান। অবসায়ন বা সমাপন হল একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোম্পানির কার্যসংক্রান্ত পরিচালনার ভার তার পরিচালকের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া।