কক্সবাজারের অদূরে ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালী মিষ্টি পান উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। সাড়ে ১৮ হাজার একর জমিতে প্রতি বছর মিষ্টি পানের চাষ করে অর্ধলক্ষাধিক পানচাষি। এ পান দেশীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও রফতানি হচ্ছে। প্রাচীন উপমহাদেশের প্রাগৈতিহাসিক রাজ দরবারে এই মহেশখালীর মিষ্টি পানের কদর ছিল খুব বেশী।
ইতিহাসবিদ ড. সলিমুল্লাহ খানের মতে, রাজ দরবারের অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম অনুসঙ্গ ছিল মহেশখালীর মিষ্টি পান। পানি পথে বণিকেরা জাহাজে বা কাঠের তৈরি পাল তোলা নৌকায় করে মহেশখালী দ্বীপে যাতায়াত করতেন। দেশের একমাত্র পাহাড়ি জনপদ ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। আর দ্বীপের মূল উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে পান, লবণ ও চিংড়ি অন্যতম। পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে এক তৃতীয়াংশ লোক। বছরের ১২ মাস যারা পান চাষ করেন তাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। কারণ পান চাষে অনেক পুঁজির প্রয়োজন। তাই হত দরিদ্ররা পান চাষে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করতে পারেন না।
মহেশখালী দ্বীপের কালার মারছড়া ইউপির ফকির জুমপাড়া গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে মাহবুবুর রহমান একজন সফল পানচাষি। তার রয়েছে ১ একর জমিতে ৫টি পান বরজ। প্রতি সপ্তাহে এই পান চাষি ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার পান বিক্রি করে স্বাভাবিক সময়ে। পানের বাজার দর উঠা নামা করে বিভিন্ন সময়। পানের বাজার দর চড়া থাকলে সপ্তাহে সর্বোচ্চ লাখ টাকাও বাজারে পান বিক্রি করে উপার্জনক্ষম বলে জানান পান চাষি মাহবুবুর রহমান।
তবে মাহবুব পান চাষে নানা রকম সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। যেমন, এই চাষ খুবই ব্যয় বহুল পরিশ্রম এবং যত্নের ফসল বলে উল্লেখ করেন। আজকাল পান বরজের উপকরণ সামগ্রীর দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে গাছ, বাঁশ, কীটনাশক, জৈবসার, শন ও লেবারসহ অন্যান্য জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খুবই কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠেছে পান চাষ।
তাই পান চাষি মাহবুব মনে করেন জিনিসপত্রের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতির কারণে পান চাষির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। পান একটি অন্যতম কৃষি পণ্য হওয়া সত্বেও পান চাষিরা যুগ যুগ বছর ধরে অবহেলিত।
মহেশখালীর পান চাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনিল কান্তি দে জানান, পান বরজের উপকরণ সামগ্রীর দাম যে হারে বাড়ছে এতে চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তাই ধান, গম ও পাট উৎপাদনে যেভাবে সরকার ভতুর্কি দিয়ে যাচ্ছে সে হারে পানচাষিদেরও একই সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ পান চাষিরা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। পান চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার দাবিতে চাষিরা আন্দোলন করে যাচ্ছেন দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে। আজও পান চাষিদের কোনো দাবি পূরণ হয়নি। দেশের একমাত্র মিষ্টি পান উৎপাদনকারী মহেশখালীর পানচাষিরা সরকারের প্রণোদনা, ভতর্কি বা সহজ শর্তে ঋণ থেকে বঞ্চিত হলে কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে পারে মিষ্টি পান উৎপাদন।
তাই মাহবুবের মতো সফল পান চাষিও যেমন আছে মহেশখালীতে তেমনি পুঁজির অভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছেন না এমন চাষির সংখ্যাও নেহায়েত কম না।
প্রয়াত চট্রগ্রামের আঞ্চলিক গানের রাণী শেফালী ঘোষের জনপ্রিয় গান ছিল এ রকম, ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম মহেশখালীর পানের খিলি তারে বানাই খাবাইতাম’।এভাবে গানে কবিতায় উপন্যাসের পাতায় পাতায় মহেশখালীর মিষ্টি পান অনন্য উচ্চতায় মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে বহু কাল ধরে। কবি সাহিত্যিকরা মনে করেন বাণিজ্যিকভাবে তো বটেই প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ মহেশখালীর ঐতিহাসিক মৈনাক পর্বতের চতুর পাশে ঢালু জমিতে যে মিষ্টি পান উৎপাদিত হয় তা দুনিয়ার আর কোথাও হয় না। এ কারণেই মহেশখালীর মিষ্টি পান এত গুরত্ব ও তাৎপর্য বহন করে বিশ্ব জুড়ে।